December 23, 2024, 3:36 am
আব্দুল্লাহ আল কাওছারঃ খুলনা কয়রায় বিগত এক বছরে ২ বার ঝড়ে কপাল পুড়েছে গ্রামবাসির।ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’র সতর্কবার্তায় উপকূলের মানুষের চিন্তার শেষ নেই। ‘আগে এত ঘন ঘন ঝড় আসত না। দু-তিন বছর পরপর একবার হতো। আর এখন ১ বছরে দু-তিনবার ঝড় আসে। কয়রা এলাকার বেড়িবাঁধের অবস্থা ভালো না।
উপকুল এলাকার ঘরবাড়ির অবস্থাও ভালো না। আবার ঘূর্ণিঝড় দানা আসতিছে। কী যে হবেনে, আল্লাহ জানে। প্রতিবার ঝড় আসলি শেষ পর্যন্ত ঘরে থাকার চেষ্টা করি। আর বাতাসের তোড় বেশি হলি তখন সাইক্লোন শেল্টারে যাতি হয়। প্রতিবছর এইভাবে জান নিয়ে ছুটতি হয়। আর ঝড়ে বেড়িবাঁধ ভাইংগে, ঘরবাড়ি ভাইংগে এখন বছরে দুবার ঝড়ে কয়রাবাসির কপাল পোড়ে।’
খুলনার কয়রা উপজেলার দশহালিয়া গ্রামের বৃদ্ধ মজিবার মোড়ল বুধবার সকালে নিজের ঝুপড়ি ঘর ঠিক করার সময় এভাবেই আক্ষেপ করেন। কপোতাক্ষ নদের বাঁধের ঢালে এই ঘরে স্ত্রী জবেদা বেগমকে নিয়ে থাকেন তিনি।
মজিবার জানান, ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলায় বেড়িবাঁধ ভেঙে তাঁর দুই বিঘা ফসলি জমি কপোতাক্ষ নদে চলে যায়। ২০২০ সালে ঘূর্ণিঝড় আম্পানে ভিটেবাড়ি হারিয়ে পথে বসেন তিনি। সে সময় দুই ছেলে চলে যায় এলাকার বাইরে। একমাত্র মেয়ের বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রী রয়ে যান কপোতাক্ষের ঢালে।
কয়রার পাথরখালী এলাকার শাকবাড়িয়া নদীর বাঁধের ঢালে বসবাস করে ১০টি পরিবার। যাদের ফসলি জমি তো দূরের কথা, বসতভিটাও নেই। সেখানকার বাসিন্দা মজিদা বেগম বলেন, ‘প্রতিবছর একটা না একটা দুর্যোগ লেগেই আছে। দুর্যোগের খবর শুনতি আর ভাল্লাগে না। এর চাইতে খোদাতালা আমাগে যদি একবারে তুলি নিত, তালি মুক্তি পাতাম। এভাবে বাঁইচে থাকতি কত যে কষ্ট, তা আমরা ছাড়া কেউ বুঝতি পারবে না।’শুধু এ দুটি পরিবারই নয়; একের পর এক ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও বেড়িবাঁধ ভেঙে বিপর্যস্ত উপকূলীয় খুলনার কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা ও বটিয়াঘাটার লাখো পরিবার। তাদের প্রত্যেকের জীবনের গল্প প্রায় একই রকম। এবার আবার ঘূর্ণিঝড় ‘দানা’ নিয়ে উপকূলজুড়ে উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে।গত ২৬ ও ২৭ মে ঘূর্ণিঝড় রিমালে ৩৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে ১৫ কিলোমিটার ইতোমধ্যে মেরামত সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু ২৩ কিলোমিটার জরাজীর্ণ বাঁধ মেরামত করা সম্ভব হয়নি। ঘূর্ণিঝড়ের ফলে জলোচ্ছ্বাস বা জোয়ারের পানির চাপ বাড়লে বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয় প্লাবিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এ ব্যাপারে পানি উন্নয়ন বোর্ড খুলনা-২-এর নির্বাহী মো. আশরাফুল আলম জানান, ২৩ কিলোমিটার বাঁধ মেরামতের জন্য সম্প্রতি দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮ কোটি টাকা। দরপত্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে কার্যাদেশ দিতে মাসখানেক সময় লাগবে। আপাতত বেশি ঝুঁকিপূর্ণ কয়েকটি স্থানে কিছু মেরামত কাজ করা হয়েছে।
আবহাওয়া অফিসসহ বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, গত ১৭ বছরে কমপক্ষে ১৬টি ঘূর্ণিঝড় আঘাত করেছে দেশের উপকূলে। এর মধ্যে ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘণ্টায় ২৬০ কিলোমিটার বেগে বাতাসের সঙ্গে ১০/১২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস নিয়ে আঘাত করেছিল ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’। এতে বাগেরহাটে ৯০৮ জন ও খুলনায় ৪৫ জনের প্রাণহানির পাশাপাশি লোকালয় লন্ডভন্ড ও সুন্দরবন ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর ২০০৯ সালের ২৫ মে ঘূর্ণিঝড় ‘আইলা’য় খুলনায় নিহত হয়েছিল ৫৭ জন, সাতক্ষীরায় ১১ ও বাগেরহাটে ৮ জন। প্রাণহানির পাশাপাশি বেড়িবাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়।
২০১৩ সালের ১৬ মে নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম উপকূলে আঘাত করে ঘূর্ণিঝড় ‘মহাসেন’। এর প্রভাবে খুলনা উপকূলে বৃষ্টিপাত হয়। ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই ঘূর্ণিঝড় ‘কোমেন’ চট্টগ্রাম উপকূলে আঘাত করে, খুলনায় ছিল ঝোড়ো বাতাস ও বৃষ্টি। ২০১৬ সালের ২১ মে ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’ চট্টগ্রাম উপকূলে আঘাত করে। এর প্রভাবে খুলনায় ব্যাপক বৃষ্টি হয় এবং সেই সঙ্গে ছিল ঝোড়ো বাতাস। ২০১৭ সালের ৩০ মে ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ কক্সবাজার উপকূলে আঘাত হানে। এর প্রভাবে খুলনায় বৃষ্টির সঙ্গে ছিল ঝোড়ো বাতাস।২০১৯ সালের ৩ মে ঘূর্ণিঝড় ‘ফণী’র আঘাতে খুলনায় ৪ হাজার ৬৪০টি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ওই বছরের ১০ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় ‘বুলবুল’-এর আঘাতে খুলনায় গাছচাপা পড়ে দু’জন নিহত হন। সুন্দরবনের ৪ হাজার ৫৮৯টি গাছ ও সাড়ে ৯ হাজার ঘরবাড়ি, ২ হাজার ৭৭২টি চিংড়ি ঘের ও পুকুর প্লাবিত, ২৫ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়। ২০২০ সালের ২০ মে ঘূর্ণিঝড় ‘আম্পান’-এর আঘাতে বেড়িবাঁধ ভেঙে খুলনায় লোকালয় ও জলোচ্ছ্বাসে সুন্দরবনের বনভূমি প্লাবিত হয়। লোকালয়ের ৮৫ হাজার ঘরবাড়ি ও সুন্দরবনের ১২ হাজার ৩৫৮টি গাছপালা ভেঙে যায়।২০২১ সালের ২৬ মে ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’-এর আঘাতে খুলনার কয়রায় বেড়িবাঁধ ভেঙে ৩৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়। প্রায় ছয় হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত, ৪/৫ ফুট উচ্চতার জোয়ারে তলিয়ে যায় সুন্দরবনের বনভূমি। মারা যায় চারটি হরিণ। একই বছরের ৬ ডিসেম্বর ঘূর্ণিঝড় ‘জাওয়াদ’-এর প্রভাবে কয়রায় বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয় প্লাবিত হয়। ২০২২ সালের ৯ মে ঘূর্ণিঝড় ‘অশনি’র প্রভাবে খুলনায় ভারী বৃষ্টি হয়। ওই বছরের ২৪ অক্টোবর ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’র আঘাতে কয়রায় বেড়িবাঁধ ধসে যায় এবং ১ হাজার ৬০০টি ঘরবাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।২০২৩ সালের ১৪ মে ঘূর্ণিঝড় ‘মোকা’ দেশের বিভিন্ন এলাকায় আঘাত করলেও খুলনায় তেমন প্রভাব ছিল না। এরপর ২৫ অক্টোবর ঘূর্ণিঝড় ‘হামুন’ আঘাত করলেও তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ১৭ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’র প্রভাবে খুলনায় ভারী বৃষ্টি হয়। ফসলের ক্ষতি হয়।চলতি বছরের ২৬ ও ২৭ মে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় ‘রিমাল’। রিমালের তাণ্ডবে ২০ হাজার ৭৬২টি ঘরবাড়ি সম্পূর্ণ ও ৫৬ হাজার ১৪২টি ঘরবাড়ি আংশিক বিধ্বস্ত হয়। ৩৫৫ হেক্টর পুকুর, ১০ হাজার ২২৪ হেক্টর চিংড়ি ঘের, ১ হাজার ৫৯০ হেক্টর কাঁকড়া ও কুচিয়া খামার প্লাবিত হয়। ১ হাজার ৬৮ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সুন্দরবনে বেশ কিছু গাছপালা ভেঙে পড়ার পাশাপাশি মৃত্যু হয় ১৩৪টি হরিণ ও চারটি শূকরের।
খুলনার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বিতান কুমার মণ্ডল বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলার জন্য তারা প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। প্রস্তুত রাখা হয়েছে সাইক্লোন শেল্টার, স্বেচ্ছাসেবক, শুকনো খাবার ও সুপেয় পানি।